সকালের সূর্যটা অপূর্ব ঝিলমিল আলোয় জ্বলছে । ঝিলমিল আলোর ঝলকানিতে গাছের পাতাগুলো কেমন যেন প্রাণের পরশে আন্দোলিত । কচিকচি পাতার ফাঁকে দোয়েল ,ময়না , চড়ুই ,শালিক পরষ্পরের সাথে সুরের লুকুচুরি খেলায় মত্ত। পুকুরের জলে সৃষ্ট সোনা রোদের রশ্মি রেখায় চোখ ঝলসে উঠে। সমুদ্রের বাঁধ ভাঙা ঢেউগুলো অবিরাম এসে দোল খাচ্ছে কিনারায়। দূর সমুদ্রের মাঝে লাল আলোর সূর্যটা কিছুক্ষণ আগে ঠিক যেন প্রকৃতিকে এই রকমই জাগিয়েছে। হঠাৎ এক টুকরো কালো মেঘ স্বচ্ছ আলোকে মৃয়মান করে দিলো।
দিনটি শ্রাবনের নয় ,তবুও আজ সারা বেলায় আকাশে মেঘের বিচরণ। কালো মেঘের রাজ্যে আজ মনে হচ্ছে আর এক মিনিটের জন্যও রোদ্দুর ঠাঁই নেই। একটু পরেই ঝিম ধরে বৃষ্টির মাতলামি। থেমে থেমে বৃষ্টি যেন পুরো দিনটাকে সাঁঝের কিনারায় নিয়ে এলো। চারদিকে সাঁঝের আঁধার জাগ্রত প্রকৃতিকে ঘরে ফেরার তগিদ দিচ্ছে পুরানো ঢঙে। তবুও এখনো বৃষ্টি থামার নাম গন্ধ নেই । ক্লান্ত পাখির দল মেঘ সাঁতরে নীড়ে ফিরে যাচ্ছে। দূর মাঠে রাখাল বেবুজ বাঁশির সুর থামিয়ে গরুর পাল নিয়ে বাড়ি ফিরছে কাঁদামাটি মাড়িয়ে।
গোধুলীলগ্নে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আমি, আকাশের দিকে পলকহীন চোখজোড়া দিয়ে তাকিয়ে আছি। বাবাকে আজ বড্ড মনে পড়ছে। ছেলেবেলায় বৃষ্টি দেখলে বই খাতা ছেড়ে বাবার কাছে বায়না ধরতাম গল্প শুনার জন্যে। সাথে মাকে বলতাম সাদা চালের খিচুড়ি রান্না করার জন্যে। গল্পের ফাঁকে ফাঁকে খিচুড়িতে মুখ দিয়ে সময় কাটতো।
আজ খুব ইচ্ছে করছে এমন বর্ষনমুখর দিনে বাবার মুখের গল্প শুনতে। গোপীবাগা, কুটুম পাখি, সাতরাজার ধন এক মানিক, হীরক রাজার রাজত্ব, পরীর দিঘীর কাহিনী, সাপের মুখে মানিক, ঠাকুরমার ঝুলি, আনারস কাঁঠাল এবং বাবার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত অনেক গল্প ও কাহিনী। গল্পের ফাঁকে ফাঁকে কখনো কখনো উঁকি মারতো একটু চোখের জল।
বৃষ্টির প্রতিটি ফোটা যেন আজ বাবার হাতকে স্পর্শ করতে চায়। ঐ নীল চোখ ধ্রুবতারার দিকে তাকিয়ে বাবার মুখের গল্প শুনতে চায়। কিন্তু তা যেন আজ আর হওয়ার নয়। ২০১২ সালের ২৪ মে পড়ন্ত বিকেলে এক অপ্রত্যাশিত দূর্ঘটনায় আমাকে ছেড়ে (ডা. মোমতাজ উদ্দিন আহাম্মদ) চলে গেলেন না ফেরার দেশে। বাবা যে আজ আমার থেকে অনেক দূরে । এই বৃষ্টি, এই সূর্য, এই নক্ষত্র বিহীন কোন অজানায়।
কিন্তু এই অবুজ মনকে কে বুঝাবে? ফ্রেমে বাঁধা বাবার ছবি ঝুলে আছে দেয়ালে। সেই হাসিমাখা মুখ, টান টান চোখের ছাউনি। মুখ জুড়ে ছড়িয়ে আছে এক অসীম মায়া, ¯েœহ আর ভালোবাসা। দেখলে মনে হয় না বাবা আমার অভিমান করে আমায় ছেড়ে দূরে চলে গেছে অনেক দূরে। কিন্তু এ যেন বাস্তবতা। কেমন করে পারলে বাবা? কেমন করে পারলে?
এখন আর কেউ প্রত্যাহ রাত ১১টায় গঞ্জ থেকে এসে আরিফ বলে ডাক দেয় না। বাজার থেকে ডিমওয়ালা ইলিশ মাছ এনে কেউ সামনে দাঁড়ায় না। দাঁড়ায় না এক ঝলক হাসি আর না বলা গল্পের কাহিনী শুনাতে।
বাবা তুমি কি আজ তোমার আরিফকে দেখতে পাও? বৃষ্টির রাজত্বে আজ ঘাসের বুকে শিশিরের দল ঠাঁই পাইনি। আঁধারের পথ ধরে বাদুড়ের দল ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে না পেয়ারা বনে। মধ্য রাতের ভূতুম পেঁচার ডাক যেন বিষন্নতার আকাশ ছঁই না। কালো মেঘের আড়ালে কলঙ্কহীন চাঁদের আলো মায়াজাল সৃষ্টি করছে। এক অজানা কষ্ট ঘিরে রেখেছে আমার মনের চারপাশে। সব আগের মতোই আছে । শুধু বাবা নেই।
নিশিথ স্বপ্নের স্বাদ যেন স্বর্গের নিমন্ত্রন। আজ আমি সেই স্বপ্ন ভেঙে নিশি ফোটা ফুলের সঙে রাত জেগে বাবার কাছে চিঠি লিখি। বাতাসে উড়িয়ে দিই আকাশের ঠিকানায়। প্রতি বছর ১৬ই জুন বাবা দিবসে বাবা তোমার প্রতি রইল আমার অকৃত্রিম ভালোবাসা আর তোমাকে না পাওয়ার কষ্টে জমানো অশ্রু গড়ানো জল।
রাত ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। এক সময় মেঝেতে লুটিয়ে পড়ি বাবাকে দেখার স্বপ্নে। বুকের মাঝে চেপে ধরি বাবার ছবিটাকে।
বাবা তুমি লুকিয়ে আছ কোন অজানার মাঝে
স্বর্গ নরক তোমায় খুঁজি সকাল বিকাল সাঁঝে।
তারিখঃ২৪/০৫/২০১৩ইং
মুরহুম ডা. মোমতাজ উদ্দিন আহামেদ(১৯৪৩-২০১২)